একটা পুকুরে ৪০ টা মাছ। এরা খাবারের কষ্টে আছে, কারণ, পুকুরে ৪০ টা মাছের খাবার মতো পর্যাপ্ত খাবার নেই।
পুকুরওয়ালা করলো কী, আরও ১০ টা মাছ পুকুরে ছেড়ে দিলো!
এখন, মাছেদের মধ্যে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি কী অবস্থায় পৌঁছাবে?
দেখা যাবে, সবল মাছেরা আরও সবল হচ্ছে, দুর্বল মাছেরা না খেতে পেয়ে আরও দুর্বল হচ্ছে। শেষে এক সময় দেখা যাবে, মাছেরা একে অন্যকে খেয়ে ফেলছে।
একটা বাজারে ৪০ টা ছোট-বড়, নতুন-পুরাতন দোকান আছে। সবগুলো দোকানে একই পণ্য বিক্রি হয়। প্রয়োজনের তুলনায় দোকান বেশি হওয়ায় ক্রেতা নিয়ে দোকানগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগেই থাকে।
এর মধ্যে বাজারে নতুন ১০ টা দোকানের অনুমোদন দেওয়া হলো। নতুন দোকানগুলো পুরাতন দোকান থেকে কিছু সেলসম্যান ভাগিয়ে নিলো। কিন্তু ক্রেতা আগেরগুলোই রইলো।
দোকানগুলোর কী অবস্থা হবে?
পণ্য যেহেতু একই, নতুন দোকানগুলো কম দামে বেচতে বাধ্য হবে। একটা কিনলে একটা ফ্রি টাইপের অফার দেবে। কিম্বা নিম্নমানের পণ্য কম দামে ক্রেতাদের গছাবে।
পুরাতন দোকানগুলোকেও ক্রেতা ধরে রাখতে নানা ধরনের ফন্দিফিকির করতে হবে।
শেষমেশ, পুরা বাজারের ইকোসিস্টেম ই নিম্নমানের হয়ে যাবে।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে যখন একসাথে ৯টা নতুন ব্যাংক দেবার কথা উঠলো, তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। রাজি ছিলেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। একটু অর্থনীতি বোঝা কোনো মানুষও এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না।
তারপরও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়টা ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হলো।
এইসব ব্যাংকগুলো নতুন কোনো সার্ভিস অফার করেনি। পুরাতন ব্যাংকের যা সার্ভিস ছিলো- সেগুলোকেই কপি করেছে। এমনকি নতুন কোনো কাস্টমার সেগমেন্ট এর কাছেও এরা সার্ভিস অফার করেনি।
পুরাতন ব্যাংকগুলোর মতো এদের সবারই প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে ঢাকায়।
এইসব ব্যাংকগুলো পুরাতন ব্যাংক থেকে কর্মকর্তা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে।
এখন, আমানতকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য এরা কী করতে পারতো?
নিজেদের কাছে আমানত আনার জন্য এদেরকে নানা প্রকার ব্যবসা বিরুপ-পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে। সব শ্রেণির আমানতকারীদের রেইট বাড়াইয়া দেওয়া, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে ডিপোজিট আনা, কর্মকর্তাদের অযৌক্তিক টার্গেট দেওয়া- কিছুই করতে বাকি রাখেনি এরা।
ডিপোজিট না হয় এলো। লোন কীভাবে দেবে এরা?
অন্য ব্যাংকের লোন কাস্টমার ভাগিয়ে আনার উপায় কী? তারা কেনোই বা আসবে নতুন ব্যাংকে?
রেইট কমাইয়া দেওয়া একটা অপশন হতে পারতো। কিন্তু তারা তো অলরেডি বেশি রেইটে ডিপোজিট নিয়ে ফেলেছে। রেইট কমাইয়া লোন দিতে গেলে তো লাভের জায়গায় লস হয়ে যাবে।
উপায়?
উপায় একটা আছে। পুরাতন ব্যাংক থেকেই তো নতুন ব্যাংকে কর্মকর্তারা এসেছেন, ম্যানেজাররা এসেছেন। তারা পুরাতন ব্যাংকের লোন কাস্টমারদের লিমিট বাড়াইয়া দেবার প্রলোভন দেখালেন।
ধরেন, পুরাতন একটা ব্যাংকের একটা শাখায় একটা কাস্টমারের ৫০ লাখ টাকার একটা ক্যাশ ক্রেডিট লিমিট ছিলো। সেই শাখার ম্যানেজার নতুন একটা ব্যাংকে জয়েন করেছেন।
ম্যানেজার পুরান কাস্টমারকে বললেন, ভাই, আমার ব্যাংকে আসেন, আপনার লিমিট ১ কোটি কইররা দিমুনে।
টাকা দেখলে নাকি কাঠের পুতুলও কথা কয়। কাস্টমার তো গলবেনই। তিনি চলে আসেন নতুন ব্যাংকে।
এক বছর পর সেই কাস্টমারের লিমিট আবার বাড়ে। এইবার দুই কোটি। ম্যানেজারের তো বিজনেস টার্গেট ফুলফিল করতে হবে!
দুই কোটি লিমিট পাইয়া কাস্টমার তো আগডুম বাগডুম।
কিন্তু এক বছরে তো তার ব্যবসার পরিধি বাড়েনি। তিনি একটা গাড়ি কিনে ফেলেন! একটা জমিও মনে ধরে তার।
জমি কিনতে গেলে তো আরও টাকা লাগবে।
এইবার কাস্টমার যান আরেক নতুন ব্যাংকের শাখায়। ম্যানেজারকে বলেন, ভাই, অমুক ব্যাংকে আমার দুই কোটি লিমিট আছে। আপনি যদি আমারে ৫ কোটি দেন...
সেই ম্যানেজার তো আকাশের চাঁদ পেয়ে যান হাতে!
দেড় বছরের মধ্যে ৫০ লাখের কাস্টমার হয়ে যান ৫ কোটির মানুষ।
৫০ লাখে বছরে ইন্টারেস্ট দেওয়া লাগতো সাড়ে সাত লাখ। সেই টাকা ইন্টারেস্ট দিয়েও আগে তার কিছু লাভ থাকতো।
এখন ৫ কোটিতে ইন্টারেস্ট আসে ৭৫ লাখ। এতো টাকার ব্যবসা তো তার না। ব্যাংকের টাকা দিয়ে তিনি গাড়ি কিনেছেন, জমি কিনেছেন- এগুলো তো কিছু আয় করে না!
বছর যায়। লিমিট বাড়ে। ইন্টারেস্ট সার্ভিসিং করতে পারেন না কাস্টমার।
একসময় এই লোন ক্লাসিফায়েড হতে বাধ্য।
এদিকে নতুন-পুরাতন সব ব্যাংকেরই কাগজের প্রফিট বাড়ে প্রতি বছর। আর বাড়ে বিজনেস টার্গেট।
আরও বাড়াতে হবে ডিপোজিট, বাড়াতে হবে এডভান্স আর বাড়াতে হবে প্রফিট।
দেশের বাজেট বাড়ে, দেশের মানুষের হাতে টাকা বাড়ে, কিন্তু দেশের মানুষের পারচেজিং পাওয়ার বাড়ে না। ব্যাংকগুলো শয়ে শয়ে কোটি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করে।
যেহেতু সব ব্যাংকেরই লোন বাড়াতে হবে, ব্যাংকগুলো লোন এপ্রাইজাল প্রসেসে ছাড় দিতে শুরু করে। লোন পেতে শুরু করে এমন সব কাস্টমার, যাদের লোন পাবার কথা নয়। এবং সেইসব কাস্টমারের লোন নেওয়ার উদ্দেশ্য ব্যবসা করে লোন ফেরত দেওয়া নয়, উদ্দেশ্য লোন নিয়ে টাকা বিদেশে পাচার করা!
এভাবে, ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে মোট ডিপোজিট বাড়ে, মোট লোন বাড়ে, ব্যাংকের অপারেটিং প্রফিট বাড়ে।
এসালাম একাই অনেকগুলো ব্যাংকের সব টাকা লোন নিয়ে নেন, দরবেশ নেন কয়েকটা ব্যাংকের সব লোন।
এভাবে ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি আস্তে আস্তে পড়ে যায় গাড্ডায়।
লোন ক্লাসিফিকেশন এবং প্রভিশনিং এ প্রতি বছরই ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
তারপর এলো চব্বিশের আগস্ট। সব জারিজুরি ফাঁস হলো।
এখন ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে মোট ক্লাসিফায়েড লোন ৩ লাখ কোটি টাকার উপরে। ২০ টা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা।
এখনো অনেক ক্লাসিফায়েড লোনকে ভালো দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। সত্যিকারের ক্লাসিফিকেশন করলে মোট ঋণের অন্তত অর্ধেক পড়ে যাবে মন্দ ঋণের খাতায়।
নয়টা নতুন ব্যাংক দেওয়া ই যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির আজকের করুণ চিত্রের একমাত্র কারণ, সেটা বলছি না। তবে, এটা যে এই দুর্যোগের অন্যতম অনুসঙ্গ, সেটা বলাই যায়।
আমাদের অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায়। সেটার দাম আমাদেরকে কড়ায় গন্ডায় দিতে হবে।
কেউ যদি ভেবে থাকেন, দেশের ব্যাংকগুলো থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা লুট হয়ে গেলে সেটা দেশের অর্থনীতিতে কোনো প্রভাবই ফেলবে না- তার সঙ্গে তর্ক করবার অভিপ্রায় আমার নেই।
ইদানীং শুরু হয়েছে এই অসুখের আরেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া- সব ডিপোজিট চলে যাচ্ছে গুটিকয়েক ব্যাংকে। সেই ব্যাংকগুলো আবার ট্রেজারি বন্ডে টাকা খাটিয়ে অকল্পনীয় মুনাফা করছে।
প্রাইভেট সেক্টর ক্রেডিট গ্রোথ কমছে আর কমছে।
দেশের ব্যবসায়ীরা যদি ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ না পান, তাহলে উৎপাদন করবেন কী দিয়ে? বাজারে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ হবে কী করে?
টাকা কি খাওয়া যায়?
চন্দন আজিজ | Post Link | 10 May 2025
Comments:
Abdullah Al Masum
একদম সঠিক।
এখন যেটা হচ্ছে, দুর্বল ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছেনা। আবার গভর্নর স্যার বলছেন দুর্বল ব্যাংকে টাকা রেখে বিপদে পড়বেননা। আবার এদিকে সরকারের নির্দেশে সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংক কে টাকা ধার দিচ্ছে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট এর জন্য। সেই টাকা পাওয়ার পরে দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহকরা তাদের ডিপোসিট তুলে নিচ্ছে এবং সেই টাকা এখন সবল ব্যাংকে রাখছে। এদিকে সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংক কে টাকা দিয়ে মুনাফাও পাচ্ছে, মানে লাভের উপর লাভ। এর শেষ কোথায়।
দুর্বল ব্যাংক কে স্থায়ীভাবে ভাল করার উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছিনা। আমার জানামতে কিছু ব্যাংক এখোনো টাকা দিতে পারছেনা। কিস্তি করে করে টাকা দিচ্ছে, বুথ বন্ধ, অনলাইন বন্ধ, অনেক গ্রাহক চিকিৎসা করার জন্যোও টাকা তুলতে পারছেনা।
চন্দন আজিজ
Abdullah Al Masum দূর্বল ব্যাংককে ভালো করার কোনো ফরমুলা আমার জানা নেই। আমার ধারণা, গভর্নর স্যারেরও জানা নেই। আপনার যদি জানা থাকে, শীঘ্রি গভর্নর স্যারকে ফোন দেন।
Ridwan Anam
চন্দন আজিজ উপায় আছে। যে আউমীরা লাইসেন্স পেয়েছে, তাদের ক্যাপিটাল ইনজেক্ট করতে হবে। কিন্তু তারা তো সেটা করবে না।
Comments